হায় পেঁয়াজ! তোমাকে নিয়ে যে রাজনীতি শুরু হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই অস্থির হয়ে পড়েছেন। অথচ তুমি হচ্ছো সংস্কৃতির বিষয় অর্থাৎ রন্ধন প্রণালীতে তোমার প্রয়োজন অনেকটা অপরিহার্য।
শুধু যে বাংলার মানুষ রান্নাতেই পেঁয়াজ ব্যবহার করে তা কিন্তু নয়, অনেকেই সকালে রসুন আর দুপুরে ভাতের সঙ্গেও পেঁয়াজ খেয়ে থাকেন। এটা অনেকদিনের অভ্যাস।
এখন পেঁয়াজ কিনতে গেলে, বাজারে যখন যাই তখন মাথায় হাত পড়ে। ৩০-৪০ টাকা কেজি যে পেঁয়াজ বিক্রি হওয়ার কথা তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে; অবশ্য খুচরা (হয়তো কয়েকদিনের জন্য)।
এই যে হঠাৎ করে দাম বাড়িয়ে দেয়া এটা তো পেঁয়াজসংক্রান্ত ব্যবসায় যারা জড়িত তাদের কারসাজি, লাভের আশায়। না হলে এই তো দু’তিন দিন আগে ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, আজ কেন হঠাৎ ২০-৩০ টাকা প্রতি কেজিতে বেড়ে গেল।
পেঁয়াজ নিয়ে এই ‘হায় মাতরম’ অবস্থা কেন সৃষ্টি হয়েছে? আমাদের নাকি ২৭ লাখ টন পেঁয়াজের প্রয়োজন। সরকার বলে ২৩ লাখ টন আমাদের উৎপাদন আর কমবেশি লাখ টন আমদানি করতে হয়।
সে কথা আবার ব্যবসায়ী নেতারা কন্ট্রাডিক্ট করে বলেছেন ঠিক উল্টো। আমাদের নাকি ৩০ লাখ টন আমদানি করতে হয়। যাকগে সেসব কথা, আমাদের ঘাটতি পূরণের জন্য আমাদের প্রিয়তম বন্ধু প্রতিবেশী ভারতের ওপর নির্ভর করি। ইন্ডিয়ান ট্রাকভর্তি পেঁয়াজের চালান আসে আমাদের দেশে। ভারতীয় পেঁয়াজ কিন্তু আমাদের পেঁয়াজ থেকে ভিন্ন। স্বাদও অন্যরকম। আমরা পাটনাই পেঁয়াজ কিংবা বোম্বাই পেঁয়াজ বলে যে জাতের পেঁয়াজ আমদানি করি, সেগুলো আকারে বড় হয়, আমাদের পেঁয়াজের চেয়ে চারগুণ বড় এবং আমাদের পেঁয়াজের মতো তাতে ঝাঁজ থাকে না আর স্বাদেও মিষ্টি মিষ্টি ভাব।
একটা কথা তো ঠিক, ঘাটতি পূরণ করার জন্য যে দেশ থেকেই পেঁয়াজ আসুক না কেন, আমাদের অধিকাংশ গৃহিণী দেশি পেঁয়াজ পছন্দ করেন। ইদানীং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ দেখা দিয়েছে, আর সে কারণেই ওদের পেঁয়াজের উৎপাদন নাকি কমে গেছে।
সেই কারণে অবশেষে, এই তো সেদিন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আনার আগাম চাহিদা জানানো থাকলেও ভারতের ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ দেয়া হঠাৎ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হল, বন্যার প্রকোপে ফারাক্কার পানিবণ্টনের সংকট দূর করার জন্য সুদীর্ঘকাল থেকে যে ‘গোফ্তোগু’ চলছিল তার সুরাহা আজ পর্যন্ত হয়নি।
উত্তরবঙ্গের বিরাট প্রান্তর মরুভূমি না হলেও বিরান হয়ে গেছে। সে কথা আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে আমরা তো বোঝাতে পারিইনি, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার- কংগ্রেস কিংবা বিজেপি, কেউই মমতার একগুঁয়ে মনোভাবকে সমাধান করতে পারেনি।
অথচ বন্যায় যখন প্লাবন দেখা দিয়েছে তখন ফারাক্কা বাঁধের স্লুইসগেটগুলো খুলে দিয়ে ভারতের বন্যার পানিতে আমাদের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের যে দুর্ভোগ তৈরি হচ্ছে সেদিকে ভারতের কোনো খেয়াল নেই। শুনলাম বিহারের পানিসম্পদমন্ত্রী নাকি ফারাক্কা বাঁধ ভেঙেই দিতে বলেছেন। এসব দেখে বাংলাদেশের কিংবা দারুণ সুসম্পর্কের প্রতিবেশী ভারতের কি বোধোদয় হবে? যাকগে এসব তো পানি নিয়ে কথা। কিন্তু পেঁয়াজের সমস্যা যখন দেখা দিয়েছে তখন কিন্তু সেই বন্ধু ভারতই বাংলাদেশে পেঁয়াজ পাঠানো, বলা নেই, কওয়া নেই, বন্ধ করে দিয়েছে। তাহলে তাদের আচরণ কি পানি কিংবা পেঁয়াজে একই নয়?
বাংলাদেশ এখন বৈরী মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছে ঘাটতি পূরণের জন্য। আর সেই সুযোগ নিয়ে ওরা যে পেঁয়াজ পাঠাচ্ছে তার মধ্যে নাকি মাত্র ৩০ শতাংশই অব্যবহার যোগ্য। এ কি ইচ্ছাকৃত? আবার এর দামও বেশি। সরকারি মুখপাত্র বলছেন, মিসর, তুরস্ক বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে, চিন্তা করার কিছু নেই। তবে বাংলাদেশে ওই পেঁয়াজ কবে পৌঁছাবে সে সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। বলছেন, হয় তো ‘৭ কী ১০ দিন’ লাগতে পারে। যেটা ভাবছিলাম সরকারি কর্মকর্তারা এ পেঁয়াজ আনার ব্যবস্থা যদি করেই থাকেন, তবে কী তারা জানেন না কতদিন লাগতে পারে জাহাজ পৌঁছাতে? এমন পেঁয়াজ সংকটের সময় সরকারি কর্তাদের বোধহীন কথা ক্ষুব্ধ করে। আবার বাজারেও এর প্রভাব পড়ে।
এ সংকট মোকাবেলার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের সঙ্গে আদৌ কোনো বৈঠক করেছেন কিনা জানি না। তবে তিনি ‘দুম’ করে বললেন, ‘দু’একদিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকা হয়ে যাবে।’ আহা! কী আনন্দের কথা।
তিনি বলেছেন বুধবারে (০২.১০.২০১৯), হিসাব অনুযায়ী শনিবারে পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকায় নেমে আসবে এটা আমরা ধরে নিলাম। অন্য এক সংবাদে দেখলাম মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন- ‘পেঁয়াজের দাম ৫৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত না।’ ধন্যবাদ বাণিজ্যমন্ত্রী।
আনন্দ আর ধরে না। আপনারা তো ৪৫ টাকা দরে টিসিবির মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ট্রাকে ট্রাকে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। আশঙ্কা জাগছে শনিবারের পর এটাও আবার ৬০ টাকায় উঠে যাবে না তো। মন্ত্রী মহোদয় পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয়ার কথাও বলেছেন।
আমরা তো সবাই সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক কাজে যাওয়ার আগে একথালা পানতা কিংবা কড়কড়া ভাত খাওয়ার সময় কাঁচা পেঁয়াজ কামড়ে ‘লোকমা’ মুখে দিতেন। আর তেল-মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে কড়কড়া ভাত খেতেন। এ তো ছিল তাদের ভোর থেকে ‘বেলা গড়িয়ে’ যাওয়া পর্যন্ত পেটের আধার। এভাবেই তো কৃষক মাঠে, শ্রমিক কল-কারখানায় কাজ করতেন। ভাবছি এ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কী হবে? হয়তো সংকট হবে না, তবে আগের মতো পেঁয়াজ খাওয়াও চলবে না বলেই আমার ধারণা।
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর এলেই এ ঝঞ্ঝাট আমাদের ব্যাকুল করে তোলে। কেন আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একত্রে বসে মৌসুমি পণ্য হিসেবে পেঁয়াজের এ দুর্গতি বিনাশের জন্য চেষ্টা করি না? হয়তো বৈঠক হয়; কিন্তু সে বৈঠকের সদূরপ্রসারী কোনো প্রভাব নেই বলেই তো মনে হচ্ছে। কেন এমন হয়? এ কি একেবারেই দূর করা যায় না? ছোটবেলায় পড়েছি ‘ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়’। আমরা যতই আধুনিক হই কিংবা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে ধাবিত হই, আমাদের তো যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য সদিচ্ছা থাকতে হবে আর সেটা দুর্যোগ আসার অনেক আগে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রতি বছরের এ ধরনের দুর্যোগ যখন আসে বা সংকট দেখা দেয়, তখন সরকার ও ব্যবসায়ীরা হয়তো অনেক বৈঠক করেন, তা থেকে মানুষকে আশ্বস্ত করে প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু হায়! তাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয় না, সংকট সংকটই থেকে যায়। বরঞ্চ বাজারে ক্ষত সৃষ্টি হয় আগের চেয়েও বেশি। আমরা কি কখনও ১২০ টাকায় পেঁয়াজ খেয়েছি? কিন্তু এখন সেই দামেই পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। খোলাবাজারে সরকারের দেয়া ৪৫ টাকা দরের পেঁয়াজও নাকি ‘সোনার হরিণ’ হয়ে গেছে। শুনছি ট্রাকে যে পরিমাণ পেঁয়াজ বরাদ্দ থাকে প্রতিদিন, জনপ্রতি ২ কেজি করে দিতে গেলে ২০০ লোকের মধ্যেই সেটা শেষ হয়ে যায়; কিন্তু লম্বা লাইনে দাঁড়ানো বাকি লোকগুলো কী করবেন?
বহু বছর আগের কথা, সম্ভবত পঞ্চাশের দশকে লবণের দাম অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল। তখন ৪-৬ আনা সের দরে লবণ বিক্রি হতো। হঠাৎ কী যে হল লবণ হয়ে গেল ১৬ টাকা সের। মানুষ চঞ্চল হয়ে উঠলেন; কারণ লবণ তো রান্নার কাজে অপরিহার্য।
আবার গরিব লোকেরা এক গামলা পানতা ভাত খানিকটা লবণ দিয়ে চেটেপুটে খেতে পারতেন। সেই বৈরী পরিবেশে প্রচণ্ড গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল রাজনৈতিক বিরোধীদের সুবাদে। এমনকি সেই লবণ সংকটে আন্দোলনে গান রচিত হয়েছিল ‘মোরা ষোল টাকা সের দরে লবণ খেয়ে, স্বর্গে যাবো গো, স্বর্গে যাবো গো।’
কিন্তু আজ সত্তর বছরেরও বেশি সময় পরে পেঁয়াজের অত্যধিক দাম বাড়ায়, সবাই ঝাঁজ অনুভব করছেন; কিন্তু সেই ঝাঁজে আন্দোলন গতি পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরি মনোভাবের যে নির্লজ্জ উল্লম্ফন দেখতে পাচ্ছি, তা সত্যিই মনে ঘৃণা পয়দা করে।
কেন বললাম? পাঠক, দেখেছেন তো ঢাকার শ্যামবাজার আর চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে যখন ম্যাজিস্ট্রেট হানা দিয়েছেন তখন কিন্তু পাইকারি দরও ১০০ থেকে ৬৫তে নেমে এসেছে। হায়রে মানুষ, এতই লোভ দু’দিনের এই সংসারে?